বাংলাদেশে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো ক্যান্সার। বাংলাদেশে সমস্ত মৃত্যুর ১০ শতাংশের মূলে ক্যান্সার, যা ২০১৮ সালে প্রায় ১০৮,০০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী রয়েছে এবং প্রতি বছর আনুমানিক দেড় লক্ষ মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হয়। নতুন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ২০৩৫ সালে এটি ২৫ লাখে পৌঁছাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীদের জন্য বিশেষজ্ঞের অনুপাত মাত্র ১:১০,০০০, ভারতে যেখানে এখন ১:১৬০০।
ক্যান্সার মানসিকভাবে ক্লান্তিকর এবং অনেকের জন্য এটি আর্থিকভাবে ধ্বংসাত্মক রুপ ধারণ করে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা, রোগশয্যা-সম্পর্কিত নিদানবিদ্যার এবং চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা, চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে যোগাযোগের অভাব, দেশীয় চিকিৎসকদের প্রতি তুলনামূলক কম আস্থা, বিভিন্ন চিকিৎসার মতামত নিয়ে বিভ্রান্তি, প্রশিক্ষিত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের এবং চিকিৎসা সুবিধার অভাব এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্য ক্রমবর্ধমান পর্যটন - এসব কারণে এখন বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীদের জন্য পরিপূরক সেবা সরবরাহ করা অনেক প্রয়োজন। অনেক ক্যান্সারের নমুনা বিশ্লেষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হয় এবং এই স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য রোগীদের নিজস্ব পকেট থেকে উচ্চ অংকের টাকা প্রদান করতে হয়।
বাংলাদেশে ক্যান্সারের বৃদ্ধিমূলক প্রবণতা কেবল ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য, জীবনমান এবং সুস্বাস্থ্যের ক্ষতিই করে না, বরং সামাজিক এবং সরকারী - উভয় স্তরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক বোঝা সৃষ্টি করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার সনাক্ত করা এবং সঠিক চিকিৎসার পরিকল্পনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে করে চিকিৎসার বিকল্পগুলো নির্ধারণ করা, মানসিক প্রভাব কমানো এবং আর্থিক বোঝা হ্রাস করা সম্ভব। নির্ভরযোগ্য ডায়াগনস্টিক্স ক্যান্সার প্রযুক্তি বাংলাদেশে এখনো সীমাবদ্ধ এবং অনেক পরীক্ষা বিশ্লেষণের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ক্যান্সার ডায়াগনস্টিক সরঞ্জামগুলো ব্যয়বহুল, কিছু ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক এবং প্রায় অসম্পূর্ণ ফলাফল প্রদান করে; তার উপর নির্ভরযোগ্য ডায়াগনস্টিকের ফলাফল পেতে প্রচুর সময় ব্যয় হয়ে যায়। উপরন্তু, কিছু ক্যান্সারের জন্য, যেমন ডিম্বাশয়ের (ওভারিয়ান), যকৃত বা অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের ভালো স্ক্রিনিংয়ের পদ্ধতিগুলো বিদ্যমান নেই, যার কারণে চিকিৎসার জন্য রোগীদের শারীরিক লক্ষণগুলো দৃশ্যমান হওয়া (ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
সফল ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য রেডিয়েশনথেরাপি সুবিধা, প্রশিক্ষিত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, মেডিকেল রেডিয়েশন পদার্থবিদ এবং প্রযুক্তিবিদদের প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার উন্নত জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে। এর পাশাপাশি গণস্বাস্থ্যের প্রচারণাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিশ্রম করার পাশাপাশি সঠিক জীবনযাপন এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। ক্যান্সার সম্পর্কিত তথ্য, নির্দেশনা এবং চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়ার জন্য ডাক্তার এবং ক্যান্সার রোগীদের জন্য কোনো ওয়ান-স্টপ হাব নেই।
রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপির অসুস্থতা যেমন ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, পেট ব্যথা এবং জ্বর দ্বারা চিহ্নিত করা সম্ভব। ক্যান্সারকে সফলভাবে লড়াই করার জন্য, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং রোগীকে প্রথমেই ক্যান্সারের কারণটি ঠিকমত বুঝতে হবে যাতে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে কোন চিকিৎসার পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় কারণ ক্যান্সার রোগের বিশাল বোঝা আমাদের মানব সমাজে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে, বিশেষত আমাদের মতো সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীর উপর। বাংলাদেশে রেডিওথেরাপি চিকিৎসার খরচের কোনও নিয়মকানুন নেই। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল স্বল্প আয়ের ক্যান্সার রোগীদের রেডিওথেরাপির একটি সম্পূর্ণ কোর্সের জন্য ১৫ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা এবং বেসরকারী হাসপাতালগুলো চিকিৎসার জন্য ২ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। এই মাত্রাতিরিক্ত খরচ সত্ত্বেও ৬০ শতাংশেরও বেশি পরিবার বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে থাকে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা দরকার: নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, স্থিতিশীল পরীক্ষাগারের ধারণক্ষমতা নিশ্চিত করা, প্রচলিত এবং আণবিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং সমন্বয় করা গুরুত্বপূর্ণ। দূর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে এই চাহিদাগুলো পূরণ করা সম্ভব হয়নি যেহেতু এখানে বিজ্ঞানীদের একটি বৃহত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অভাব রয়েছে যেখান থেকে মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং আণবিক জীববিজ্ঞানীদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব। এছাড়াও প্রয়োজনীয় স্থায়ী পরীক্ষাগার স্থাপনের জন্য রাজনৈতিক বা সামাজিক স্থিতিশীলতার অভাব এবং জটিল ক্যান্সার ডায়াগোনস্টিক্স তথ্য বিশ্লেষণের এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত অপ্রতুলতার জন্য বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে একটি স্মার্টফোন-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন, ওয়্যারলেস প্রযুক্তি, নিয়মিত স্ক্রিনিং এবং সাশ্রয়ী মূল্যে দ্বিতীয় মতামতের বিকল্প সুবিধা সহজে নিশ্চিত করতে পারলে একই সাথে ক্যান্সার রোগীদের ক্লিনিকাল লক্ষণগুলোর এবং রেডিওথেরাপি পরিচালনার সূচক হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহার করা যাবে।