বিশ্বজুড়ে মানব মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধাণ কারণ হচ্ছে ক্যান্সার, এর ফলে প্রতি বছর মৃত্যু সংখ্যা প্রায় ৯ লক্ষ ৬০ হাজার। এটা খুবই বিস্ময়কর যে আশংকা অনুযায়ী ২০৪০ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে ক্যান্সারের প্রকোপ বেড়ে গিয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ক্যান্সার প্রতিরোধে আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নেই তাহলে এই দায় বিশ্বের জন্য একটি অতিব মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। ৫০ বয়সোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ক্যান্সার মৃত্যুর হার অপরিবর্তীত রয়েছে। ক্রনিক মায়েলোজেনাস লিউকেমিয়া- যা একটি মারাত্মক রক্তের ক্যান্সার, এই ক্যান্সার নিরাময়ে আমরা খানিকটা জয় লাভ করেছি-চিকিৎসার প্রথম ধাপে কেমোথেরাপি প্রদানের ফলে ৬০ বছরের নীচে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬০% এর ক্ষেত্রে উপশম হয়েছে, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে ক্যান্সার জয়ের যুদ্ধে আমরা আসলে এখনো কিছুই করে উঠতে পারিনি। 

প্রায় ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে ক্যান্সার গবেষণার ফলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়েছে যার ফলে আমরা ক্যান্সার সম্পর্কে জানতে পেরেছি।  কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে বিশ্বের মোট ক্যান্সার আক্রান্তের মধ্যে এশিয়ায় রয়েছে ৪৮.৩%, ওশেনিয়ায় ১.৩%, আফ্রিকায় ৫.৭%, দক্ষিণ আমেরিকায় ১৩.৩% এবং ইউরোপে ২২.৮%। সর্বোপরি এটাই বলা যায় যে, ক্যান্সারকে প্রতিহত করতে সামনে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। কেবলমাত্র ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার ব্যক্তির ক্যান্সার পরীক্ষা করা হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসায় সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে শল্য চিকিৎসা, কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন। কিন্তু কেমোথেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। PET/CT স্ক্যানে অনেক উন্নতি সাধন হয়েছে এবং PET/CT স্ক্যানে CT স্ক্যান কোথায় হাড় রয়েছে তা দেখাতে এবং PET স্ক্যান কোথায় টিউমার রয়েছে তা আপনাকে দেখাতে সাহায্য করবে। 

শিমেরিক অ্যান্টিজেন রিসেপ্টর থেরাপি বা CAR থেরাপি – একটি নতুন উদ্ভাবিত ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থা, যেখানে রোগীর রক্ত থেকে টি সেল সংগ্রহ করা হয় যা টিউমারকে আক্রমণ করে ও মেরে ফেলার মাধ্যমে রোগীদের স্বীয় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে। প্রতিটি রোগীর জন্য CAR টি সেল তৈরি করতে খরচ পড়বে প্রায় ১৫০,০০০ ডলার। এই পদ্ধতিকে আরো কার্যকর ও সকল রোগীর সাধ্যের মধ্যে আনার জন্য ভবিষ্যতে আরো গবেষণা করা প্রয়োজন। বিশেষ বায়োমার্কার হিসেবে রোগের লক্ষণ সনাক্তকরণের জন্য একদম প্রাথমিক পর্যায়েই ক্যান্সার সনাক্ত করা যাবে এমন নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি ন্যানোবায়োটেকনলজি তৈরির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ন্যানোটেকনলজির মাধ্যমে ক্যান্সার সনাক্তকরণের এই পদ্ধতি ক্যান্সার রোগের হাত থেকে বেঁচে থাকতে অনেক সহায়ক হবে।

একজন রোগীর নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে তার ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে আর এই পদ্ধতিকে ইমিউনোথেরাপি বলে। যেসব রোগীদের ক্ষেত্রে মেলানোমা বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে এই পদ্ধতি ব্যবহারে তাদের এই ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হচ্ছে যা একটি অভূতপুর্ব ফলাফল। সঠিক ঔষধের প্রতিশ্রুতি ব্যক্তিভেদে সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করে যা সব ধরনের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে আমাদের জেনেটিক্স ও পূর্বের রোগের অবস্থাকে বিবেচনা করে দেওয়া হয়, যা মোটামুটি সকল রোগীর ক্ষেত্রে বহুল সংক্রমিত ও বিরল ক্যান্সারের চিকিৎসার ফলে যে ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো হয়ে থাকে সেগুলোকেও অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে যে এপিজেনেটিক থেরাপি দেওয়া হয় তা এপিজেনেটিক এনজাইম যারা একটি কোষের জেনেটিক প্রোগ্রামকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সেগুলোকে টার্গেট করে থাকে। ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করার পরিবর্তে এই থেরাপিগুলোর মাধ্যমে কোষগুলোকে পুনরায় স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়। 

আমরা একটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লব যার নাম জিনোম মেডিসিন এর অগ্রগতি দেখতে চলেছি। যেসকল ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছেন তাসের সম্পর্কে আমরা পূর্বের তুলনায় আরো অধিক জানতে পারছি। এবং অনেক বছর ধরে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর অজানা ছিল সেগুলোর উত্তর দিতেও আমরা এখন সমর্থ। আমরা জানি যে প্রায় ১০,০০০ এরও অধিক জিনের ক্ষেত্রে প্রায় ৪০,০০০ স্বতন্ত্র মিউটেশন হয়ে থাকে এবং এর মধ্যে ৫০০ টির মত জিন ক্যান্সারের জন্য মূলত দায়ী জিন। প্রায় দশক ধরে এই জিনগুলো জটিলতার কারণ হিসেবে পরিচিত। তিন ধরনের প্রোটিন: ras, myc, p53। ৮০ এর দশক থেকেই আমরা এই পুরনো তথ্যগুলো সম্পর্কে জানি, ক্যান্সার রোগীদের জন্য আরো কার্যকর ও টার্গেটেড থেরাপি উদ্ভাবনের জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। 

এই অগ্রগতিগুলোর পাশাপাশি, বেশিরভাগ ক্যান্সার রোগীদের এখনো উচ্চমাত্রার ক্ষতিকারক কে্মোথেরাপি নিতে হচ্ছে। একটি সাধারণ কারণে চিকিৎসকগণ কেমোথেরাপি চিকিৎসাপদ্ধতি দিতে অধিক পছন্দ করে থাকেন আর তা হলো: এই চিকিৎসা পদ্ধতি হয়তো কাজ করে বা ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য তাদের কাছে হয়তো এটিই একমাত্র লব্ধ। তথাপি, বেশীরভাগ ক্যান্সারই কেমোথেরাপির প্রতি সংবেদনশীল এবং অনেক ক্ষেত্রেই মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়া করে থাকে। যদিও এর ফলে ক্যান্সার রোগীরা স্বল্প সময়ে চিকিৎসা সমাধান পেয়ে থাকে এবং হয়তো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে, তবে কেমোথেরাপির ফলে সৃষ্ট দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়াগুলো তাদের সহ্য করে যেতে হবে। আমরা এমন ভবিষ্যতের আশা রাখি যখন কেবলমাত্র সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হবে এবং মেটাস্ট্যাটিক ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক রোগীর জন্য তাদের ক্যান্সার দূরীকরণে সর্বোচ্চ কার্যকর ও নূন্যতম ক্ষতিকারক থেরাপি প্রদান করা হবে। আমরা আশা করছি যে আসন্ন দশকের মধ্যে এই ধরনের প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটবে যা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করবে এবং সকলের মনে দৃঢ় আশার সঞ্চার করবে। 


Fighting Cancer Desk
ফাইটিং ক্যান্সার ডেস্ক