পরিচিত কারো ক্যান্সার চিহ্নিত হলে তা আশপাশের সবার জন্য দুঃখজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। পরিবারের সদস্য বা কাছের কেউ হলে তা আরো বেশি প্রভাব ফেলে। এরকম পরিস্থিতিতে রোগীর পরিবার বা কাছের মানুষেরা সবচেয়ে যত্নশীল পরিচর্যাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে। তাদের দায়িত্বশীল ও সহানুভূতিশীল মনোভাব রোগীর মানসিক শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি ও পরামর্শ মেনে চলার জন্য সাহায্য করে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের পাশে থেকে তাদের যত্ন নেয়ার জন্য যারা কাজ করেন, তাদের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ পুরোনো রোগীদের পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণিত কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ এ প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়েছে।
১. তথ্য সংগ্রহ ও বিস্তারিত জানা: ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সঠিক পরিচর্যা ও যত্নের জন্য ক্যান্সারের ধরন অনুযায়ী লক্ষণ, পরিচর্যা ও সার্বিক পরিস্থিতি বুঝে কাজ করার জন্য এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা জরুরি। বিভিন্ন প্রতিবেদন, তথ্যচিত্র থেকে যেমন জানার উপায় আছে, একই সাথে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এবং লিখে রাখলে প্রয়োজনে সাহায্য নেয়া যাবে। যেকোনো বিষয়ে দ্বিধা বা প্রশ্ন থাকলে বারবার শুনে নিতে হবে যাতে করে কোনো অবস্থাতেই কোনো ভুল না হয়। রোগীর শারীরিক স্বাস্থ্য বিবেচনায় এ বিষয়টি আবশ্যক।
২. নতুন পরিস্থিতি মেনে নেয়া: আপনজন ক্যান্সারের মতো কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই কাছের মানুষেরা বিচলিত হয়ে পড়েন। সামগ্রিকভাবে একটি নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় সেখানে শক্ত মনে মানিয়ে নেয়া রোগী ও পরিচর্যাকারী দুই পক্ষের জন্যই প্রয়োজনীয়।
৩. ইতিবাচকতা: রোগীর সাথে মোটামুটি সবসময় যারা যত্ন নেয়ার জন্য থাকেন, তাদের মনোভাব ও কথাবার্তা অবশ্যই ইতিবাচক হওয়া উচিত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যেকোনো নেতিবাচক কথা কিংবা বারবার রোগীর অবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ রোগীকে আরো আতঙ্কিত করে তোলে। তাই রোগীকে সবসময় উৎসাহ দিতে হবে, তিনি তার পথের একজন সফল যোদ্ধা - তা বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে।
৪. নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীলতা: সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের মাঝে অনেক সময়ই রোগীর সেবা দানকারী মানুষগুলো নিজেদেরই যত্ন নিতে উদাসীন হয়ে পড়েন। রোগীর জন্য স্বস্তির পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে নিজের শরীর ও মনের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। দুটোর মধ্যে কোনো একটাও ভালো না থাকলে রোগীর সাথে আচরণ ও যত্ন নেয়া দুই ক্ষেত্রেই বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। রোগীর খাদ্যাভ্যাসের মতো নিজের জন্যও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হবে।
৫. নিজের ও রোগীর জন্য আনন্দময় পরিবেশ তৈরি: একঘেয়ে পরিবেশে বেশি দিন সুস্থ মনে বসবাস করা যেকোনো মানুষের জন্যই কষ্টকর। বিশেষত যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং যারা ক্যান্সারে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত, তাদের জন্য এ ধরনের পরিবেশ মোকাবেলা করা আরো বেশি কঠিন হয়ে ওঠে। তাই মাঝেমধ্যেই পছন্দের গান শোনা, কবিতা আবৃত্তি, অনুপ্রেরণামূলক চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্র দেখা, ডায়েরী লেখা, ছোট ছোট খেলাসহ বিভিন্নভাবে নিজেদের ও রোগীর মন প্রফুল্ল করে তুলতে চেষ্টা করেন সেবা দানকারীরা। এ ধরনের কাজ দায়িত্বশীলতার সাথে পালন করার জন্য মানসিক শক্তি ও প্রশান্তি অভাবনীয় ভূমিকা রাখে।
৬. কাজের ধরন বদলে নেয়া: সবসময় একই ধরনের কাজে পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকলে ধীরে ধীরে সেই কাজের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং আগ্রহের অভাব দেখা দিতে পারে। তাই অন্যদের সাথে কাজ বদলে নিলে একঘেয়ে ভাব কেটে যাবে, একই সাথে বিরক্তি প্রকাশ না করে রোগীর যত্ন নেয়া যাবে।
৭. নিজের সুবিধা-অসুবিধা খুলে বলা: পরিচর্যাকারী যদি নিজের অপারগতার কথা সরাসরি খুলে বলার অভ্যাস তৈরি করেন, তাহলে কোনো কাজ তাকে জোরপূর্বক করতে হবে না। সেক্ষেত্রে কাজে ভুল হয়ে রোগীর যেকোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা যেমন কমে যায়, তেমনি রোগীও ধীরে ধীরে নিজের সব সমস্যার কথাগুলো পরিচর্যাকারীকে জানাতে শিখবেন।
৮. রোগীর সাথে সঠিক যোগাযোগ: অনেক সময়ই সংকোচ বোধ থেকে রোগী সব ধরনের সাহায্য চাইতে পারেন না, সেবাদানকারীর উচিত রোগীর জন্য সেই আপন পরিবেশ তৈরি করা। এ ধরনের যোগাযোগ তৈরি করতে পারলে চিকিৎসা পদ্ধতি ও সার্বিকভাবে রোগীর মতন নেয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। অন্তর্মুখী হয়ে না থেকে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বললে, নিজেদের সুখদুঃখ আলোচনা করলে, একসাথে পছন্দের কোনো খেলা বা চলচ্চিত্র দেখলে ভালো যোগাযোগের বন্ধন তৈরি করা সম্ভব।
ক্যান্সারের চিকিৎসায় রোগীর সাথে সেবাদানকারীর সম্পর্ক ও যোগাযোগ চিকিৎসকের সাথে রোগীর সম্পর্কের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। বরং এক্ষেত্রে সম্পর্কটি আরো বোঝাপড়া ও বন্ধুত্বের হতে হবে। তাহলেই রোগী ও পরিচর্যাকারী দুই পক্ষই নিজেদের যত্ন নিতে অনুপ্রাণিত হবে, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার পথযাত্রার ক্লান্তি ও কষ্ট কিছুটা হলেও কম হবে।