আমার চারপাশের মানুষগুলো, যেমন-লাইফ পার্টনার, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, সন্তান, বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনরা বিষয়টা কিভাবে নেবে-আপনি যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন বিশেষত ক্যান্সার আক্রান্ত অবস্থায় এই ভাবনাগুলো খুব সহজেই আপনাকে ভাবিয়ে তোলে।ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে আপনার মনে এক ধরনের মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হতে থাকে এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে খানিকটা পরিবর্তন আপনার দৃষ্টিগোচর হয়।
একজন ক্যান্সার রোগীর সাথে জড়িয়ে থাকা সম্পর্কগুলো কিভাবে পরিবর্তীত হয় আজকের এই লেখায় সেই বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এবং অনেক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীই হয়তো তাদের সাথে উল্লিখিত বিষয়গুলোর মিল খুঁজে পাবেন।
দম্পতির উপর প্রভাব
ব্যক্তি এবং দম্পতিভেদে এই প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে দাম্পত্য সম্পর্ক আরো মজবুত হয়ে উঠে বা কারো ক্ষেত্রে দুঃখজনক হলেও বিপরিতও ঘটে থাকে। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ফলে নিজেদের দায়িত্ব, ভূমিকা, চাহিদা (শারীরিক ও মানসিক), অন্তরঙ্গতা ও শারীরিক সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবনে অনেক চড়াই উতরাই আসে।
দায়িত্ব
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে পরিবারে প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু কাজ সুনির্দিষ্ট থাকে। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ফলে শরীরতন্ত্র দূর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রায়শ তাদের পক্ষে প্রাত্যহিক কাজগুলো করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে স্বামী/স্ত্রী তাদের সঙ্গীর ভাগের কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে থাকেন এবং যারা কর্মজীবি তারা তাদের নিয়মিত কাজের সময়ের অতিরিক্ত কাজ করে থাকেন যাতে করে খানিকটা বাড়তি আয়ের মাধ্যমে আর্থিক সংকুলান বজায় রাখা যায়।
ভূমিকা
ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার আগে যে ব্যক্তি সকলকে আগলে রাখতেন বা সকলের ভরসাস্থল ছিলেন পরিস্থিতির কারণে তাকেই অন্যের উপর নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী হতে হয় এবং যিনি নিশ্চিন্তে আপনমনে জীবন কাটাচ্ছিলেন তাকে হঠাৎ করে অনেকটা দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়; প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকেন একজন উপযুক্ত সেবাপ্রদানকারী ও ভরসাস্থল হয়ে উঠার।
চাহিদা (শারীরিক ও মানসিক)
ক্যান্সার এবং এর চিকিৎসার প্রভাব একজন ক্যান্সার রোগীর খাদ্যাভ্যাস এবং কায়িক শক্তির উপর পড়ে, এই কারণে একজন রোগীর উচিত তার এই পরিবর্তিত চাহিদা সম্পর্কে সঙ্গীকে খোলাখুলিভাবে অবগত করা অন্যথা অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে।
একজন ক্যান্সার রোগী যখন জানতে পারে তার শরীরে এক মরণব্যধি বাসা বেঁধেছে এর মানসিক প্রভাব দুজনের উপরেই পড়ে- যেমন দুঃখ, হতাশা, উদ্বিগ্নতা, ভয়, রাগ উভয়ের মনেই কাজ করতে থাকে। এই অনুভূতিগুলো সময় ও পরিস্থিতিভেদে পরিবর্তিত হতে থাকে। তাই দুজনেরই উচিত দুজনকে আশ্বস্ত করা যে আগে তারা যেমন ছিল এখনো তারা দুজন দুজনকে আগের মতই ভালোবাসে।
অন্তরঙ্গতা এবং শারীরিক সম্পর্ক
ক্যান্সার এবং এর চিকিৎসার একটা বড় প্রভাব পড়ে সেক্সুয়াল লাইফের উপর। শারীরিক এবং মানসিক নানা পরিবর্তনের সাথে সাথে একজন ক্যান্সার রোগীর বমিবমি ভাব হওয়া, অবসন্নতা, বিষাদগ্রস্ততা, যৌন উত্তেজনা অনুভব না করা, শুষ্ক যোনিপথ, দূর্বলতা-এই বিষয়গুলো অন্তরঙ্গ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। এর ফলে যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যায় এবং সহজাত বিষয়টি অনেকসময় যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আপনার সঙ্গীর ক্যান্সার আক্রান্তের খবরটা আপনার আশা আর স্বপ্নগুলোকে মুহুর্তেই ভেঙে চুরমার করে দেয়।
বাচ্চাদের উপর প্রভাব
বাবা বা মা হিসেবে আপনি স্বভাবতই ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি আপনার সন্তানদের সাথে শেয়ার করতে চাইবেন না। কিন্তু সত্যি বলতে কি বাচ্চারা এমনকি খুব ছোট ছোট বাচ্চারাও অনুভব করতে পারে আপনার এমন কিছু একটা হয়েছে যা ঠিক ভালো নয়। তারা হয়ত পরিবারের অন্যান্যদের কথোপকথন থেকে আপনার ক্যান্সারের বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে। এর ফলে তাদের মধ্যে একটা ভীতির সৃষ্টি হবে, পুরো ব্যাপারটা তালগোল পাকিয়ে যাবে এবং মনে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। তাই বাচ্চাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলুন, ক্যান্সার আক্রান্তের বিষয়ে তাদেরকে বোঝান এবং এটাও তাদেরকে বোঝাতে হবে যে যেকোনো সময় খারাপ কিছু একটা ঘটতে পারে আপনার সাথে; সেই অনুযায়ী এখন থেকেই তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের উপর প্রভাব
সম্পর্কের নৈকট্যতার উপর ভিত্তি করে এই সম্পর্কগুলোও পরিবর্তিত হবে। কেউ কেউ আপনার পাশে থাকবে আবার কেউ কেউ কোন অজ্ঞাত কারনে আপনার থেকে একটা দূরত্ব তৈরি করবে। আপনি আপনার নিজের অসুস্থতা সম্পর্কে বারে বারে সকলকে একই উত্তর দিতে দিতে হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়বেন তাই পরিবারের বিশ্বস্ত কাউকে অনুরোধ করুন যাতে সে সবাইকে সময়ে সময়ে আপনার ব্যাপারে আপডেটগুলো জানিয়ে দেয়। কিছু মানুষ আপনাকে এড়িয়ে চলবে কারণ আসলে তারা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারে না যে আপনাকে তারা কি বলবে বা কি বলা উচিত এই পরিস্থিতিতে। কেউবা একজন ক্যান্সার রোগী হিসেবে আপনাকে ভয় পেয়ে দূরে সরে যাবে। কারো প্রিয়জন হয়তো ইতিপূর্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে আপনাকে দেখে সেই অতীত স্মৃতি যেন পুনরায় স্মৃতিপটে ভেসে না উঠে সেই কারনেও অনেকে আপনাকে এড়িয়ে চলবে। আবার কিছু মানুষ তাদের ভালোবাসা আর স্নেহের তাগিদে আপনার পাশে থাকবে। কেউবা যেকোন মূল্যে আপনাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করবে। কেউবা আপনার মনোবল যুগিয়ে আপনার পাশে থাকবে।